সড়ক দুর্ঘটনায় দেশজুড়ে একের পর এক মানুষ মরছেই। ২৯ জুলাই রাজধানীর
র্যাডিসন হোটেলের উল্টো দিকে কুর্মিটোলায় ফ্লাইওভারের ঢালে দুই বাসের
রেষারেষিতে নিহত হয় দুই শিক্ষার্থী। নিহত দুই শিক্ষার্থী হলো শহীদ
রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম ওরফে
রাজীব (১৭) এবং একই কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম ওরফে মিম (১৬)। এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে আরও ১৩ জন। এর মধ্যে একজনের
অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ ঘটনায় দেশ এখন অনেকটাই উতপ্ত। হয়তো এটাও ঢাকা পরে যাবে, আবার কোন দুর্ঘটনার আড়ালে। এভাবে চলছেই।
এই তো কিছুদিন আগে ১ জুলাই, বসুমতি পরিবহনের বাসের চাপায় নিহত হন জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র শাহরিয়ার সৌরভ। এর এক দিন পরেই ২ জুলাই
মিরপুরে দিশারী পরিবহনের বাসের চাপায় নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী
সৈয়দ মাসুদ রানা। এর আগে গত ১৭ মে মেয়র হানিফ
ফ্লাইওভারে দুই বাসের রেষারেষিতে আহত হওয়ার পর প্রাণ হারান একটি অনলাইন
গণমাধ্যমের কর্মকর্তা নাজিমউদ্দীন।
এছাড়া ৩ এপ্রিল রাজধানীর পান্থপথে রাজীবের হাত কাটা পড়ল, সেই রাজীব আজ পরপারে। ৫
এপ্রিল সকালে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় গৃহবধূ আয়েশা খাতুনের মেরুদণ্ড
ভাঙল। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তিনি আর কোনোদিন দাঁড়াতে পারবেন না। ১১ এপ্রিল
ফার্মগেটে বেসরকারি চাকরিজীবী রুনি আক্তারের পা থেঁতলে গেল। পায়ের
কার্যক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ১৪ জুলাই রাজধানীর গুলিস্তান মোড়ে যাত্রীবাহী বাসের চাপায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ
হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নার্স ঝুমুর আক্তার রাখির ডান পায়ের পাতা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ১৮ জুলাই রাজধানীতে ওমর ফারুক নামে এক ব্যক্তির মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে বাসের চাকা। রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।এতে
ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ৫০ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি। তিনি বারডেম হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের এক চিকিৎসকের গাড়িচালক ছিলেন।
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিল্গউএইচও) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে- বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা
হয়েছে, দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো, চালকের মাদক গ্রহণ, সিটবেল্ট না বাঁধা,
হেলমেট ব্যবহার না করা, ট্রাফিক আইন না মানা এবং শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয়
নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় বাংলাদেশের সড়ক ব্যবহারকারী তথা চালক, যাত্রী ও
পথচারীরা দুর্ঘটনার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই প্রতিদিনই রাস্তায় তাজা
প্রাণ ঝরে যাচ্ছে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশসহ সদস্যদেশগুলো অঙ্গীকার করেছিল ২০১১ থেকে ২০২০ সালের
মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো দুর্ঘটনা
ও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৭ সালে এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় দুর্ঘটনায় মারা
গেছে এক হাজার ৯৬০ জনেরও বেশি মানুষ। আহত ও পঙ্গু হয়েছে আরও কয়েকগুণ
মানুষ। প্রতি মাসে ২১৮ জন এবং প্রতিদিন গড়ে ৭ দশমিক ২৫ জন মানুষ মারা
যাচ্ছে।
এছাড়া বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক
দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ১২ হাজার মানুষ। দুর্ঘটনাকবলিত কোনো যানবাহনের চালককে
আটক করা হলেও বেশিরভাগ সময়ই তাদের শাস্তি হয় না। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার
সমস্যা, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা, জরুরি ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনাহীনতাও
দুর্ঘটনা বাড়ার পেছনে দায়ী। শুধু চালকের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে শতভাগ
নৈতিক ও কঠোর থাকতে পারলেই দুর্ঘটনা বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
আমাদের মাঝে অবশ্যই অনেকের সড়ক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। যানবাহনের ধাক্কা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে অনেকের। দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা উদ্বেগজনক রূপ নিয়েছে। তার অন্যতম কারণ হলো, আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকা। নেই কোনো নির্দিষ্ট ও
সময়োপযোগী নীতিমালা, নেই উপযুক্ত শাস্তির বিধান। ফলে বাস মালিক থেকে শুরু
করে ড্রাইভার, যাত্রী, পথচারী কেউই আইনের তোয়াক্কা না করে যেমন খুশি
নিজেদের পরিচালিত করছে। বাস মালিকদের কাছ থেকে বাস নিয়ে চালক-হেলপাররা
স্বস্তিতে গাড়ি চালাতে পারছে না। দিন শেষে মালিকদের নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা
বুঝিয়ে দিতে হয়। জ্যামের শহরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করে বাসচালকরা
যথেষ্ট ট্রিপ দিতে ব্যর্থ হয়, তার ওপর বাসের তেল ও অন্যান্য খরচও আছেই।
কিন্তু দিন শেষে মালিককে টাকা বুঝিয়ে দিতেই হবে আর এ কারণে চালক-হেলপার
প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে বাস চালায়। তাদের লক্ষ্য থাকে অন্য বাসের তুলনায়
অধিক যাত্রী বহন করা ও যথেষ্ট আয়-উপার্জন করা। চালক-হেলপারদের চিন্তায়
আপনার-আমার মতো যাত্রীদের নিরাপত্তার ব্যাপারটা থাকে না।
রাজধানীর অনেক রাস্তায় সিগন্যাল বাতি নেই, যা আছে তার অধিকাংশই নষ্ট। ফলে
ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা ঠিকমতো গাড়ি চলাচল নিশ্চিত করতে পারেন না। ফলে বাসে
থাকা যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যাম-সিগন্যালে আটকে বিরক্ত হয়ে যায়।
সিগন্যাল ছাড়া মাত্রই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে বাসের চালক-হেলপারদের গালাগাল করতে
থাকে। অনেক সময় তা অকথ্য ভাষায় চলে যায়। আর চালকরা উত্তেজিত হয়েই সিগন্যাল
পার হতে থাকে। দুর্ভাগা তারাই, যেসব পথচারী এ সময়টা রাস্তা পারাপারের
চেষ্টা করে। রাজধানীর অধিকাংশ দুর্ঘটনা এ কারণেই হয়।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় কারণ বেপরোয়া গতি, তাছাড়া রাস্তা ঘাটের বেহাল দশাও মূলত সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। অদক্ষ চালকের হাতে বেপরোয়া
গতির যানবাহন হয়ে উঠেছে মৃত্যুর দূত। গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সর্বোচ্চ
কঠোর না হলে অপমৃত্যু থামানো যাবে না। সড়ক দুর্ঘটনার এই বাড়বাড়ন্ত সরকারের নির্দেশনা রয়েছে। গত ২৫ জুন সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলোর একটি হলো এই যে- যানবাহনের কোনো চালক টানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি যান চালাবেন না। এটা তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এ থেকে পরিষ্কার হলো সমস্যাটি কত গুরুতর। এ থেকে আরও স্পষ্ট হলো যে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব এই সমস্যার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কারণ, এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর অধিকাংশই ঘটে চালকদের কারণে। সড়কভেদে প্রতিটি যানবাহনের জন্য গতি
নির্দিষ্ট করে তা মানতে বাধ্য করতে হবে।বেপরোয়াভাবে যান চালানো এবং একটানা দীর্ঘ সময় চালানো দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়। তাই প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা বিনা ব্যতিক্রমে দেশের সবখানে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে যানবাহনের মালিকদের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন, তাঁরা যেন একই চালককে দিয়ে দীর্ঘ সময় যানবাহন না চালান, সেটা পরিবহন মালিকদের সম্মিলিতভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী যানবাহনের চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন।দক্ষ চালক তৈরির ক্ষেত্রে কোনো
ছাড় দেওয়া যাবে না। এটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রশিক্ষণ ও অদক্ষ চালক-সহকারীদের কারণেও অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আমাদের দেশে প্রশিক্ষিত চালক ও সহকারীর ভীষণ ঘাটতি রয়েছে; তাঁদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। যাকে-তাকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করা না গেলে
কখনোই সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে না। একই সঙ্গে বন্ধ করতে হবে
ফিটনেসবিহীন গাড়ি। একটি গবেষণা অনুযায়ী, মাদকাসক্ত চালকের কারণে দেশে ৩০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে।
মাদকাসক্ত চালকের লাইসেন্স বাতিল করাসহ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
চালকদের সিটবেল্ট ব্যবহারের প্রতি অনীহা গ্রহণযোগ্য নয়।
এ দেশে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটে রাস্তা পারাপারের সময়, চলন্ত যানবাহনের ফাঁকফোকর দিয়ে হেঁটে রাস্তা পারাপারের প্রবণতা ঢাকা শহরে অত্যন্ত বেশি। প্রধানমন্ত্রী এদিকেও যথার্থই দৃষ্টি দিয়েছেন: তিনি বলেছেন, অতিনিয়ন্ত্রিতভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে, সে জন্য সিগন্যাল মেনে চলতে হবে, জেব্রাক্রসিং ব্যবহার করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের নৈরাজ্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থায় অনেক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব; পথেঘাটে মানুষের অসতর্ক ও অনিয়ন্ত্রিত চলাফেরার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসাও সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশের
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।এ বিষয়গুলোতে কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না। তবে এসব ছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনা না কমার আরও একটি বড় কারণ- দায়ী চালকদের বিচার না হওয়া।
দোষী হলেও চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হার খুবই কম। এতে চালকরা আরও
বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। চালকদের সঙ্গে মালিক প্রতিষ্ঠান ও পরিবহন সংগঠনগুলোকেও
সচেতন হতে হবে। দুর্ঘটনায় আহত-নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা
করতে হবে এবং শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিও সচেষ্ট হতে হবে।










































