Thursday, July 26, 2018

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন যারা

 ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষার শুরু ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর। ১৮৫৭ সালে ভারতের বড় লাট লর্ড ক্যানিং 'দ্য অ্যাক্ট অফ ইনকরপোরেশন' পাশ করে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হল কোলকাতা, বোম্বে এবং মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়। এর আগে থেকেই ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল কিন্তু এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় ইউরোপিয় মডেলে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ছিল উঁচু। আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিলেন মূলত পশ্চিম বঙ্গের উঁচুতলার হিন্দু সন্তানরা। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আগে অবিভক্ত বাংলায় ১৯টি কলেজ ছিল। তার মধ্যে পূর্ব বাংলায় নয়টি। তবে সেটাই পর্যাপ্ত ছিল বলে মনে করেননি তখনকার পূর্ব বাংলার মানুষ।

কেন পূর্ববঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন ছিল:

১৯০৫ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সি ভাগ করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন এক প্রদেশ করা হয়। যার প্রচলিত নাম বঙ্গভঙ্গ। পূর্ববঙ্গে পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসা ছিল এই উদ্যোগের একটি অংশ। বঙ্গভঙ্গের এই সময়টা ছিল খুব অল্প সময়ের জন্য, মাত্র ছয় বছর। কারণ এর মধ্যেই পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু নেতারা প্রবল আন্দোলন করেন এই বঙ্গভঙ্গের। 
এদিকে মুসলমান নেতারা নতুন প্রদেশ হওয়াতে শিক্ষাসহ নানা সুবিধা পাবেন এই আশায় উজ্জীবিত হন।  কিন্তু গোটা ভারতবর্ষে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তাদের বিরোধিতার মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। ফলে মুসলমানদের ক্ষোভ আরো পুঞ্জিভূত হতে থাকে। তারা মনে করে অর্থনৈতিক বৈষম্যের সাথে সাথে শিক্ষা ক্ষেত্রেও তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।


যারা বিরোধিতা করেছিলে:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বিরোধী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নাম সৈয়দ আবুল মকসুদের 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা' বইতে উঠে এসেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোকজনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন বলে উল্লেখ করা হয়। ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে তাঁর ঢাকা সফর শেষে কলকাতা প্রত্যাবর্তন করলে ১৯১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তার সাথে সাক্ষাৎ এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতামূলক একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।
এসংক্রান্ত বিভিন্ন বইতে উঠে এসেছে, লর্ড হার্ডিঞ্জ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কী মূল্যে অর্থাৎ কিসের বিনিময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবেন?
শেষ পর্যন্ত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারটি নতুন অধ্যাপক পদ সৃষ্টির বিনিময়ে তার বিরোধিতার অবসান করেছিলেন। পরবর্তীতে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষক নিয়োগে সহযোগিতা করেন। তার সঙ্গে ছিলেন স্যার নীলরতন সরকার।

কেন এই বিরোধিতা?:

কথা সাহিত্যিক এবং প্রাবন্ধিক কুলদা রায় তাঁর 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা ও রবীন্দ্রনাথ' নামক প্রবন্ধে লিখেছেন মূলত-বিরোধিতা করেছিলেন তিন ধরনের লোকজন-

এক. পশ্চিমবঙ্গের কিছু মুসলমান-তারা মনে করেছিলেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কোনো লাভ নেই। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদেরই লাভ হবে। তাদের জন্য ঢাকায় নয় পশ্চিমবঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়াটাই লাভজনক।

দুই. পূর্ব বাংলার কিছু মুসলমান-তারা মনে করেছিলেন, পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে ১০০০০ জনের মধ্যে ১ জন মাত্র স্কুল পর্যায়ে পাশ করতে পারে। কলেজ পর্যায়ে তাদের ছাত্র সংখ্যা খুবই কম। বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেখানে মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা খুবই কম হবে। পূর্ববঙ্গে প্রাইমারী এবং হাইস্কুল হলে সেখানে পড়াশুনা করে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়বে। আগে সেটা দরকার। এবং যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে মুসলমানদের জন্য যে সরকারী বাজেট বরাদ্দ আছে তা বিশ্ববিদ্যালয়েই ব্যয় হয়ে যাবে। নতুন করে প্রাইমারী বা হাইস্কুল হবে না। যেগুলো আছে সেগুলোও অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। সেজন্য তারা বিশ্ববিদ্যালয় চান নি।

তিন. পশ্চিমবঙ্গের কিছু হিন্দু মনে করেছিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ কমে যাবে। সুতরাং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চলবে কীভাবে? এই ভয়েই তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি বিরোধিতা করেছিলেন:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা কী ছিল সেটা নিয়ে বিস্তর লেখা-লেখি হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। যারা বলেছেন তিনি এর বিরোধিতা করেছিলেন তারা স্বপক্ষে দালিলিক কোন তথ্য প্রমাণ দেন নি।
সেই সময়কার সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা এবং রবীন্দ্রনাথের সেই সময় যাদের সাথে উঠা-বসা ছিল তাদের কয়েকজন ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে। তাই অনেকেই সহজ সমীকরণ মিলিয়ে লিখেছেন তিনিও এর বিপক্ষেই ছিলেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা' বই এ লিখেছেন "শ্রেণীস্বার্থে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন কার্জনের (লর্ড কার্জন) ওপর অতি ক্ষুব্ধ। কার্জনের উচ্চশিক্ষাসংক্রান্ত মন্তব্যের তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় কলকাতার হিন্দু সমাজে। তাতে রবীন্দ্রনাথও অংশগ্রহণ করেন। তিনি যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন,তাতে কিছু ছিল যুক্তি, বেশির ভাগই ছিল আবেগ এবং কিছু ছিল ক্ষোভ"।
আবার যারা রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতা করেননি বলেছেন তাঁরা এর স্বপক্ষে বেশ কিছু ঘটনা এবং এবং দিন তারিখের কথা উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ কোনো প্রমাণ উপস্থিত না করেই লিখিতভাবে জানাচ্ছেন যে, ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ মার্চ কলকাতায় গড়ের মাঠে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা হয়। ও রকম একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তাতে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি ছিল অসম্ভব, কেননা সেদিন তিনি কলকাতাতেই ছিলেন না। ১৯১২ সালের ১৯ মার্চ সিটি অব প্যারিস জাহাজযোগে রবীন্দ্রনাথের বিলাতযাত্রার কথা ছিল। তাঁর সফরসঙ্গী ডাক্তার দ্বিজেন্দ্রনাথ মিত্র জাহাজে উঠে পড়েছিলেন, কবির মালপত্রও তাতে তোলা হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু আকস্মিকভাবে ওইদিন সকালে রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে মাদ্রাজ থেকে তাঁর মালপত্র ফিরিয়ে আনা হয়। কলকাতায় কয়েক দিন বিশ্রাম করে ২৪ মার্চ রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে চলে আসেন এবং ২৮ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিলের মধ্যে সেখানে বসে ১৮টি গান ও কবিতা রচনা করেন"।

যারা পক্ষে কাজ করেছিলেন:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা যে হয়েছিল নানা পক্ষ থেকে সেটা ইতিহাস ঘাটলে তথ্য পাওয়া যায়।
কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আবশ্যকতা রয়েছে সেটা বোঝাতে এবং প্রতিষ্ঠার ব্যাপার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন যাঁরা তাদের কথা না বললেই নয়।
এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। কিন্তু, হঠাৎ করে ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহের মৃত্যু ঘটলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এই উদ্যোগের হাল ধরেন। অন্যান্যদের মধ্যে আবুল কাশেম ফজলুল হক উল্লেখযোগ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার হিন্দুরাও এগিয়ে এসেছিলেন। এদের মধ্যে ঢাকার বালিয়াটির জমিদার অন্যতম। জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে।








No comments:

Post a Comment